6
বেগুন চাষ পদ্ধতি

আমাদের দেশের প্রায় সব জেলাতেই  কমবেশি বেগুনের চাষ করা হয়ে থাকে। আমাদের অনেকেরই বেগুন চাষ পদ্ধতি অজানা। সারা বছরই বেগুন চাষ করা হয়। বেগুনের গাছ প্রায় ৪০ থেকে ১৫০ সেমি লম্বা হয়। আমরা বেগুন সবজি হিসাবে খেয়ে থাকি, বেগুন পুষ্টিকর ও সুস্বাদু সবজি। সঠিক নিয়মে চাষ না করার কারণে অনেক চাষীগণ লোকসান করে থাকেন।

বেগুনের জাত সমুহ

আমাদের দেশে সারা বছর বেগুন চাষ করা হলেও সব জাতগুলো সব সময় চাষ করা যায় না। দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতে স্থানীয় ফসল হিসাবে বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষ করা হয়। ভাল ফলন পেতে হলে ভাল মানের জাত র্নিবাচন করা দরকার। মৌসুম ভিত্তিতে সব জাত গুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় যেমন– শীতকালীন জাত ও বারমাসী জাত। শীতকালীন জাতের বেগুন কেবল মাত্র রবি মৌসুমেই চাষ করা হয়ে থাকে কারণ এ জাতের বেগুন শুধু মাত্র রবি মৌসুমেই ফল দিয়ে থাকে। আর বারমাসী জাতের বেগুন সারা বছরই চাষ করা যায়।

আমাদের দেশের স্থানীয় জাতগুলো হলো: ইসলামপুরী, উত্তরা, লাফফা, নয়নকাজল, মাকড়া, রাখাইন বেগুন, ঈশ্বরদি ১, খটখটিয়া, সাহেব বেগুন, তাল বা তল্লা বেগুন, কেজি বেগুন ইত্যাদি জাত।

হাইব্রিড জাতগুলো হলোঃ চমক এফ১, বিটি বেগুন,বিজয়, পার্পল কিং, কাজলা (বারি বেগুন ৪), নয়নতারা (বারি বেগুন ৫), তারাপুরী (বারি বেগুন ২), শুকতারা, ডিম বেগুন, মুক্তকেশী ইত্যাদি জাত সমুহ।

বেগুন চাষের জন্য উপযোগী মাটি ও জলবায়ু

বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ থেকে ভারী এঁটেল মাটি অর্থ্যাৎ প্রায় সব ধরনের মাটিতেই বেগুন চাষ করা হয়। বেগুন সাধারণত ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ভাল ফলন দিয়ে থাকে। তাপমাত্র এর কমবেশি হলে বেগুনের ফুল ও ফল ধারণ ব্যাহত হয়। বাংলাদেশের জন্য শীতকালীন জলবায়ু বেগুন চাষের জন্য খুবই উপযোগী।

জমি তৈরি ওচারা রোপন পদ্ধতি

আমাদের দেশে প্রায় সব মাটিতে বেগুন চাষ কর হয়ে থাকে। তবে বেগুন চাষের জন্য উর্বর জমি হতে হবে, দো-আঁশ, এটেল দো-আঁশ ও পলি মাটিতে বেগুনের ফলন ভালো হয়। যে জমিতে বৃষ্টির পানি জমে থাকে না ও সবসময় আলো-বাতাস পায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। জমি তৈরি করার জন্য ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করতে হবে।

বেগুন চাষাবাদ জমিতে কি কি দিবেন? শতক হিসেবে উদাহরণ: ১ম – প্রথম জমি চাষে ৩ কেজি ঢলো চুন। ২য়, চাষে ১০০ কেজি গোবর। ৩য়, চাষে যা যা দিবেন- ১ কেজি টি.এস.পি, ১ কেজি খইল, ৫০০ গ্রাম জিপসাম, ৭০ গ্রাম বোরন, ১০০ গ্রাম ভালো কোম্পানির দানাদার কীটনাশক, ১৫০ গ্রাম পটাশ সার সহ সব উপকরণ ভালো করে মিক্সড করে জমিতে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে ৪ দিন রেখে দিবেন। বেগুনের জাত ভেদে বেড প্রস্তুত করবেন। চারার বয়স যখন ৩৫-৪৫ দিন হয় তখন চারা রোপণের উপযোগী হয়।

এ সময় চারাতে ৫-৬টি পাতা থাকে এবং ১৫ সে.মি লম্বা হয়। বেগুনের চারা ২ মাস পর্যন্ত বীজতলায় রেখে দেওয়া যায়। বীজতলা থেকে চারা তোলার আগে পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে কারন তাহলে শিকড় নষ্ট হবে না। বেগুনের চারা জাতের ক্ষেত্রে ও চারার আকার অনুযায়ী দুরত্ব বজায় রেখে লাগাতে হয়। বড় জাতের বেগুনের জন্য ৭৫ সে.মি থেকে ৯০ সে.মি দুরে সারি করে ৫০-৬০ সে.মি দুরে দুরে লাগাতে হয়। চারা লাগানের সঠিক সময় হলো বিকালের সময়। চারা রোপনের পর সেচ দিতে হবে যাতে করে চারা শুকিয়ে না যায়।

বেগুনের সার ব্যবস্থাপনা

বেগুন চাষের জন্য সার একটি খুব গুরুত্বপূর্ন বিষয়। কৃসকদের মতে মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে বেগুন চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হবে। প্রয়োজন মতো সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাটি পরিক্ষা করে মাটির ধরন অনুযায়ী সার দিতে হবে। জৈব সার ব্যবহার করলে গুণগতমান বজায় থাকে ও পরিবেশ ভালো থাকে।

বেগুন গাছে সার দেওয়ার নিয়ম প্রতি হেক্টর জমিতে গোবর ৮ থেকে ১২ টন, ১৪৫ থেতে ১৫৫ কেজি টিএসপি, ২৪০ থেকে ২৬০ কেজি এমওপি, ৩৭০ থেকে ৩৮০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। জমিতে তিন কিস্তিতে সার প্রয়োগ করতে হয়। প্রথম কিস্তি সার জমিতে চারা লাগানের ১০-২৫ দিনপর, ফল ধরা শুরু করলে দ্বিতীয় কিস্তির সার ও ফল তোলার মাঝামাঝি সময়ে তৃতীয় কিস্তির সার দিতে হবে।

বেগুনের বিভিন্ন রোগ-বালাই ও প্রতিকার

ঢলে পড়া রোগের লক্ষন ও প্রতিকার:

বেগুন গাছে ঢলে পড়া রোগের লক্ষন দেখাদেয় যখন বেগুন গাছে ফুল ও ফল ধরে। গাছের ঢলে পড়া ডগার মধ্যে কোন ধরণের পোকা পাওয়া যায় না। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকার পরও গাছের ডগা ঝিমিয়ে ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মারা যায়। যে জমিতে বেশি পরিমাণে অম্ল থাকে সেই জমিতে বেগুন চাষ করলে এই রোগের আক্রমন হয়। ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত জমিতে পরের বছর বেগুন চাষ না করাই উত্তম। পরবর্তী বছর ভূট্রার চাষ করা উত্তম। তাছাড়া বেগুন চাষ পদ্ধতি জেনে বুঝে করা দরকার।

ঢলে পড়া রোগ থেকে গাছকে বাঁচানোর জন্য যে কাজগুলো করা সবথেকে বেশি গুরুত্বর্পূন সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

  • কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ/চারা শোধন করে নিতে হবে।
  • আক্রান্ত গাছ ও ঝড়ে পড়া পচা পাতাগুলো মাটিতে পুতে রাখেন।
  • বয়স্ক পাতাগুলো ছিড়ে ফেলেন।
  • এক লিটার পানি নিন সাথে ২ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি অথবা ব্যভিস্টিন এবার গাছগুলোকে রোপণের আগে উক্ত মিশ্রনে গোড়া ভিজিয়ে নিন।
  • ক্ষেতের গাছ আক্রান্ত হলে আগের মতো এক লিটার পানিতে ১ গ্রাম টিমসেন বা ২ গ্রাম ব্যভিস্টিনের মিশ্রন দিয়ে স্প্রে করেন।
  • প্রতি ১০ দিন পরপর ২-৩ বার ৩ গ্রাম ডাইথেন এম ৪৫ অথবা ২ গ্রাম ব্যভিস্টিনের মিশ্রন দিয়ে স্প্রে কেরে দিতে হবে।
  • ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধক জাত লাগাতে হবে।

বেগুনের ফল ও কাণ্ড পচাঁ রোগের লক্ষন ও প্রতিকার:

ফোমপসিস ভেক্সান্স নামক এক প্রকার ছত্রকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগটি বীজ, আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ এবং মাটির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। যদি কোন সময় গাছে পুষ্টির অভাব দেখা দেয় তখন এ রোগের ব্যাপকতা বেড়ে যায়।আর্দ্র আবহাওয়া এবং অধিক তাপমাত্রায় এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধিপায়।

সাধারণত নীচের পাতায় প্রথমে দাগ দেখা যায় এবং দাগগুলো স্পষ্ট গোলাকার ও ধুসর বাদামী রং ধারণ করে। মাটির উপরি ভাগের কান্ড হঠাৎ করে সরু হয়ে যায়। দাগগুলোর বয়স হলে অনেক কালো কালো পিকনিডিয়া দেখা যায়। যে পাতা গুলো বেশি আক্রান্ত হয় সেগুলো হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে। মাঝে মাঝে গাছের বাকল খসে পড়ে এবং ভিতরের কাঠ বেরিয়ে পড়ে। আক্রান্ত বেগুন গুলোতে ফ্যাকাশে বসানো দাগ পড়ে এবং আক্রান্ত স্থানে বাদামী ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত ফল খুব দ্রুত পচে যায়।

প্রতিকার:

  • সবসময় সুস্থ ও নীরোগ বেগুন থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
  • যে সকল বীজ কুচকানো ও কালো সে বীজগুলো ব্যবহার করা উচিত নয়।
  • এই ছত্রাকটি আক্রান্ত গাছের পরিত্যাক্ত অংশে বছরের পর বছর বেচেঁ থাকে। তাই আক্রান্ত গাছ ও পাতা পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে।
  • বীজ শোধন করে নিতে হবে।
  • কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ভালোভাবে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর জমির সকল গাছে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

বেগুন গাছের গোড়া পচাঁ রোগের লক্ষন ও প্রতিকার:

বেগুন চাষীদের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো বেগুন গাছের গোড়া পচে যাওয়া ও গাছ মড়ে যাওয়া। এ রোগের কারণে চাষীদের অনেক সময় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সস্কেলোরোসিয়াম রফসি নামক ছত্রাকের আক্রমন হলে বেগুন গাছে এ রোগ দেখা যায়। এই রোগটি যে কোন বয়সের গাছে হতে পারে।

প্রতিকার:

কোন সময় বাগানে আক্রান্ত গাছ দেখা গেলে দেরি না করে সাথে সাথে আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে দুরবতী স্থানে মাটির নিচে পুতে ফেলতে হবে। জমির সকল গাছগুলোকে মেনকোজেব ও কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক সঠিক নিয়মে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে বেগুন গাছে  স্প্রে করলে এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। বেগুন চাষ পদ্ধতির উপর ধারনা থাকলে সহজেই উপকার পাওয়া যায়।

সেচ ও পানি নিষ্কাসন ব্যবস্থা

বেগুন গাছের প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। বেলে মাটিতে ১০ থেকে ১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে। তাছাড়া জমিতে রস না থাকলে সেচ দিতে হয়। বর্ষাকালে বেগুনের জমিতে পানি নিষ্কাসনের ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে। বেগুন গাছ দাঁড়াণে পানি সহ্য করতে পারে না।

চাষের সময় পরিচর্যা

বেগুন চাষের জন্য পরিচর্যা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেগুনের ফলন নির্ভর করে পরিচর্যার উপর। গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য গাছের গোড়ার মাটি মাঝে মাজে আলগা করে দিতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে সেচ দিতে হবে। আর বেগুনের জমির মাটি যদি বেলে হয় তাহলে ১০-১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে। গাছের গোড়ায় পানি জমে গোড়া পচে না যায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোন ভাবেই জমিতে আগাছা জন্মাতে দেওয়া যাবেনা। আগাছা দেখাদিলে সাথে সাথে পরিস্কার করতে হবে।

বেগুন সংগ্রহও ফলন

খাওয়ার উপযোগী বেগুন সংগ্রহের সময় সাবধানে সংগ্রহ করতে হবে। সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার আগেই সংগ্রহ করতে হয়। সাধারণত ফুল ফোটার পর থেকে ফল পেতে ১ মাস সময় লাগে। লক্ষে রাখতে হবে গাছে যেন আঘাত না লাগে।  জাত ভেদে হেক্টর প্রতি ১৭-৬৪ টন ফলন পাওয়া সম্ভব।

কৃষক ভাই গণ যদি সঠিক নিয়মে বেগুন চাষ পদ্ধতি জেনে বুঝে চাষ করেন তাহলে বেশি লাভবান হবেন।

6 Comments

  1. mosaraf hossain January 26, 2021 Reply

    উন্নত ফসল উৎপাদনের কৌশল
    Post navigation
    লাউ চাষ পদ্ধতি: সঠিক নিয়মে জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
    পুষ্টিকর করলা চাষ পদ্ধতি: রোগ ও প্রতিকারের জন্য সঠিক পরির্চযা

  2. জীবনধারা September 25, 2021 Reply

    অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ…

    • Success Farm October 11, 2021 Reply

      অনেক ধন্যবাদ ভাই, প্রশংসা করার জন্য।

  3. Mohammed tareq November 18, 2021 Reply

    অনেক ধন্যবাদ

    • Success Farm November 18, 2021 Reply

      আপনাকেও ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

  4. Md Nayeem December 16, 2021 Reply

    Onk valo

Leave a Comment

Your email address will not be published.

0

TOP

X