1
জারা লেবু চাষ

জারা লেবু অত্যন্ত জনপ্রিয় ও রপ্তানিযোগ্য একটি ফসল। দিনকে দিন জারা লেবু চাষ কররা জন্য চাষীদের আগ্রহ বাড়ছে। সচারাচর প্রাপ্ত লেবুর চেয়ে জারা লেবু একটু আলাদা। সাধারণত আমরা লেবুর রস খেয়ে থাকি কিন্তু জারা লেবুর খাওয়া হয়ে থাকে চামড়া। খাবার টেবিলে সালাদ হিসাবে জারা লেবুর বেশ কদর রয়েছে। এ লেবুটির  বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণ লেবু থেকে অনেক বেশি বড়, একটি লেবুর ওজন হয়ে থাকে দুই থেকে চার কেজি পর্যন্ত। এর চামড়া বেশ পুরু তবে রসের পরিমাণ খুবই কম।

এই লেবুটির চামড়ায় একটি বিশেষ ধরণের মিষ্টি গন্ধ রয়েছে। এই মিষ্টি স্বাদটা ভোক্তাদের কাছে খুবই প্রিয়। এই লেবুটির চামড়া দিয়ে আচার তৈরি করা হয়। বর্তমাণে এই লেবুটি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। জারা লেবুর প্রধান ক্র্যতা প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

বর্তমানে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতে এই লেবুর চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জারা লেবুর বাজার মূল্য অনেক বেশি, একেকটি লেবুর দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। উল্লেকযোগ্যভাবে সিলেট জেলার গোইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলায় জারা লেবু চাষ করা হচ্ছে।

জলবায়ু ও মাটি

জারা লেবু আর্দ্র ও উচু পাহাড়ি অঞ্চলে ভালো জন্মে থাকে। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন পাহাড়ি অঞ্চেলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা যুক্ত অম্লীয় মাটি জারা লেবু চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ লেবু চাষের জন্য ২৫-৩০ সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় এবং ১৫০০-২০০০ মিলি লিটার বৃষ্টিপাতের  দরকার। এই লেবু দোঁ-আশ ও পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতা সম্পন্ন অম্লীয় মাটিতে ভাল জন্মে।

লেবুর বংশবিস্তার

জারা লেবু বীজ (চারা) ও অঙ্গজ (কলম) এই দুইভাবে  চারা উৎপাদন করা যায়। খুব ভালমানের মাতৃগুন সম্পন্ন চারা পেতে হলে কলমের চারাই উত্তম। সাধারণত গুটি কলমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয়। অঙ্গজ উপায়ে চারা উৎপাদন করলে গাছের মাতৃ গুনাগুন বজায় থাকে। কলমের চারাতে ১-১.৫ বছরেই ফল ধরে। তাই বীজের চারার চেয়ে কলমের চারাই উত্তম।

জমি তৈরি ও রোপণ পদ্ধতি

জমিতে চারা বা কলম রোপণ করার ১৫-২০ দিন আগে ৮ হাত বাই ৮ হাত দুরত্বে ৬০*৬০*৬০ সেন্টিমিটার গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের উপরের মাটির সাথে ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি সার ও ২০ কেজি  গোবর সার বা ৫কেজি কোম্পোষ্ট সার ভালভাবে মিশিয়ে নিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে।

লেবুর চারা বা কলম সারি সারি বা বর্গাকার পদ্ধতিতে রোপণ করা উচিত। যার কারণে বাগানের আন্তঃ পরিচর্যা ও ফল সংগ্রহ করতে সুবিধা হয়। এছাড়া পাহাড়ি ঢালু জমিতে আড়াআড়ি সারি করে চারা রোপন করা ভালো, তাহলে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় কম হবে।

চারা রোপণের সময়

সাধারণত বর্ষাকালে চারা লাগানোর সবথেকে ভাল সময়। এক্ষেত্রে মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা লাগানো যায়। তবে সেচের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই চারা লাগানো সম্ভব। 

চারা/কলম রোপণ ও পরিচর্যা

লেবু গাছ, মাদা তৈরি করার ১২-১৫ দিন পর লাগাতে হয়। যে পদ্ধতি গুলো অনুসরণ করতে হয় নিম্নরুপ-

  • চারা গর্তের ঠিক মাঝখানে সেজা করে লাগাতেহবে
  • চারার চার পাশের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালভাবে বসিয়ে দিতে হবে
  • চারা যাতে সোজা থাকে সে জন্য চারার সাথে লাঠি পুতে দিতে হবে
  • চারা লাগানের পরে সেচ দিয়ে দিতে হবে।

গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি

চারা লাগানের পর ভালো ফলন পেতে হলে নিয়মানুযায়ী সঠিক পরিমানে সার প্রয়োগ করতে হবে। নিম্নে বয়স অনুসারে গাছপ্রতি সারের পরিমান দেওয়া হলো।

উপরের বর্ণিত সার তিনভাগে ভাগ করে তিন কিস্ততে গাছের গোড়া হতে কিছুটা দুরে ছিটিয়ে মাটি আগলা করে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালের গাছের জন্য  ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথম কিস্তির সার বর্ষার প্রথমে অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তির সার মধ্য ভাদ্র থেকে কার্তিক মাসে ও তৃতীয় কিস্তির সার মাঘ-ফাল্গুন মাসে প্রয়োগ করতে হবে।

গাছের অঙ্গ ছাটাই

লেবু গাছের যে সকল  চিকন, শুকনো, মরা, রোগাক্রান্ত, লিকলিকে ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছাঁটাই করেতে হবে। গাছের গোড়ার দিকে জল শোধক শাখা এবং ভেতরের দিকে দুর্বল ডালপালা, মধ্য কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ছাঁটাই করে দিতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করার পর কর্তিত স্থানে  যাতে ছত্রাক আক্রমণ করতে না পারে সে জন্য বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে।

পানি সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা

জারা লেবুর বাগানে খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে। এছারা মাটির রস শুকিয়ে গেলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। লেবু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না তাই বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেজন্য নালার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

জারা লেবুর পোকা মাকড় ও রোগ ব্যবস্থাপনা

সিলেট অঞ্চলে জারা লেবুর বাগানে প্রায় ১৬ প্রজাতির পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখযোগ্য পোকামাকড় ও রোগগুলো হলো-

  • লেবুর প্রজাপতি পোকা
  • লেবু পাতার ছোট সুড়ঙ্গকারী পোকা
  • লেবুর থ্রিপস পোকা
  • লাল পিঁপড়া
  • লাল মাকড়
  • ছাতরা পোকা
  • ক্যাঙ্কার রোগ
  • স্ক্যাব রোগ

এ সকল পোকামাকড় ও রোগগুলো লেবু ফসলের ক্ষতি করে এবং উৎপাদনও ব্যাহত করে। নিচে এসকল পোকামাকড় ও রোগের হাত থেকে প্রকিকারের উপায় সমুহ আলোচনা করা হলো। 

লেবুর প্রজাপতি পোকা

এ পোকার কীড়া পাতার কিনারা থেকে খাওয়া শুরু করে থাকে। এ পোকা সাধারণত নার্সারী ও ছোট গাছে আক্রমণ করে। লেবু গাছে ফেব্রুয়ারী, জুলাই ও আগস্ট মাসে এ পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়। 

প্রতিকার:

  • বাগান সবসময় পরিস্কার পরিছন্ন রাখতে হবে
  • ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে মাটিতে পুতে রাখতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে
  • আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্নাঙ্গ পোকা ধরে মেড়ে ফেলতে হবে
  • বাগানে যদি আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে তাহলে কচি পাতার স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি, সাইপারমেথ্রিন) অথবা (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি প্রতি লিটার পানি বা ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন ৩ থেকে ৪ বার গাছে ভাল করে স্প্রে করে দিতে হবে।

লেবু পাতার ছোট সুড়ঙ্গকারী পোকা

লিফ মাইনার বা সুড়ঙ্গকারী পোকার কীড়াগুলো লেবু গাছের পাতার উপত্বকের  ঠিক নিচের সবুজ অংশ খেয়ে থাকে এবং আকা-বাকা সুড়ঙ্গের মতো তৈরি করে। পরবর্তীতে পাতার কিনারার দিকে মুড়ে পুত্তলিতে পরিণত হয়ে যায়। লিফ মাইনারের আক্রমণের মাত্রা তীব্রভাবে দেখাদিলে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় ও বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে পাতা ঝড়ে পড়ে। মুলত আগস্ট ও অক্টোবর মাসে এ পোকা বেশি দেখা যায়।

প্রতিকার :

  • বাগানে সাদা আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে
  • ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে মাটিতে পুতে রাখতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে
  • নতুন পাতা গজানের সময় কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি, সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি) অথবা (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি প্রতি লিটার পানি বা ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩ থেকে ৪ বার গাছে ভাল করে স্প্রে করতে হবে।

লাল পিঁপড়া

কয়েকটি পাতা একত্র করে লাল পিঁপড়া বাসা তৈরি করে। এতে করে সালোক সংশ্লেষণ ব্যহত হয়ে গাছের পাতা নষ্ট হয়ে যায়। আর এসব বাসায় মিলিবাগ আক্রমণ করে, ও গাছে শুটিমোল্ড রোগ দেখা দেয়।

প্রতিকার:

  • আক্রান্ত গাছ থেকে পিঁপড়ার বাসা ভেঙ্গে দিতে হবে
  • প্রয়োজনে ডারসবান ২০ ইসি ২ মিলি/লিটার পানি বা সেভিন ৮৫ এসপি ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে পিঁপড়ার বাসায় প্রয়োগ করতে হবে।

লাল মাকড়

লাল মাকড় লেবু জাতীয় ফসলের কচিপাতা ও ফলে আক্রমণ করে। এ পোকার আক্রমণে পাতার নিচের দিক বাদামি বর্ণ হয়ে পাতা কুঁকড়ে যায় ও গাছ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

প্রতিকার:

  • আক্রমণের প্রথম দিকেই আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে
  • এছাড়া মাকড়নাশক যেমন ওমাইট ৫৭ ইসি ১.৫ মিলি বা ভারটিম্যাক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

ছাতরা পোকা

এ পোকা গ্রীষ্মকালে গাছের শাখা-প্রশাখা, পাতার নিচে ও ফলের বোটার কাছে একত্রে গাঁদা হয়ে থাকে। একটি পুর্ণাঙ্গ ছাতরা পোকা পাতা, ফল, শাখা-প্রশাখার রস চুষে খায়। এ পোকা থেকে নিঃসৃত পর্দাথে শুটিমোল্ড নামক ছত্রাকের জন্ম হয়।

প্রতিকার:

  • এ পোকা আক্রমণের প্রথমেই পোকাসহ আক্রান্ত পাতা কান্ড ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে
  • এছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম সাবান পানি মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

লেবুর ক্যাঙ্কাররোগ

ক্যাঙ্কার একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ। গাছের কচিপাতায়, বাড়ন্ত কুঁড়িতে, ও ফলে এ রোগের আক্রমন বেশি হয়ে থাকে।

প্রতিকার:

  • জারা লেবু চাষের জন্য চাষীকে পরিকল্পিতভাবে পরিচ্ছন্ন বাগান স্থাপন করতে হবে
  • রোগের প্রাদুর্ভাব প্রকট আকার ধারণ করলে কুপ্রাভিট ৮০ ডব্লিউপি ৯ কপার অক্সিক্লোরাইড) প্রতি লিটার পানিতে ৭ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন স্প্রে করতে হবে
  • বোর্দোমিশ্রণ (১০০গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন লিটার পানিতে মিশিয়ে ) ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।

স্ক্যাবরোগ

অনেক সময় লেবুর চামড়ার উপর ছোট ছোট বাদামি বা লালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। এ দাগগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এবং খসখসে হয়ে যায় যা দেখতে অনেকটা দাদ রোগের মতে মনে হয়ে থাকে। লেবুর গায়ের কিছু কিছু দাগ গভির হয়ে থাকে আবার কিছু কিছু দাগ বাহিরের দিকে খাড়া হয়ে থাকে।

এ রোগ প্রতিকারের জন্য ম্যানকোজের জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। তাহলে এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

জারা লেবুর ফলন:

জারা লেবু কলম চারা রোপনের ১-১.৫ বছর বয়সে গাছ থেকে ফলন পাওয়া যায়। গাছ থেকে পাঁচ বছরেরও অধিক সময় পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। জারা লেবুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ঘ্রাণ চমৎকার খুব সুস্বাদু ও টক জাতীয় ফল। লেবুটি দেখতে অনেকটা জালি কুমড়ার মতো বড় হয়ে থাকে।

রফতানিযোগ্য লেবু উৎপাদন করতে লক্ষণীয় দিক:

রোগ, পোকামাকড় ও দাগ মুক্ত লেবু উৎপাদন করতে হবে। রোগের ক্ষেত্রে ক্যাঙ্কার রোগটি আমদানি কারকদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর তাই কোনো ভাবেই বাগানে ক্যাঙ্কার রোগটি থাকতে পারবে না। পোকার ক্ষেত্রে বাগানটি অবশ্যই লিফ মাইনার ও থ্রিপস মুক্ত হতে হবে।

লেবু তেলার সময় হাতে গ্লোবস পরে নিতে হবে। লেবু তোলার পর বাছাই করতে হবে। লেবু তোলার সময় খেয়ার রাখতে হবে কোন ভাবেই অতিরিক্ত পরিপক্ক এবং কম পরিপক্ক লেবু তোলা যাবে না।

1 Comment

  1. ZOHIR AHMED April 27, 2020 Reply

    GOOD

Leave a Comment

Your email address will not be published.

0

TOP

X