13
মরিচ চাষ পদ্ধতি

মরিচ আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। মরিচকে ইংরেজিতে Chili বলা হয়। মরিচ নিত্য ব্যবহৃত মশলা যা তরকারিকে সুস্বাদু করতে বিরাট ভুমিকা রাখে। বাংলাদেরশের প্রায় সব অঞ্চলে মরিচের চাষাবাদ করা হয়। তবে চরাঞ্চালে মরিচের উৎপাদন সবথেকে বেশি হয়ে থাকে।

আমাদের দেশের অনেক জেলাতেই বাণিজ্যিকভাবে মরিচ চাষ করা হয়। মরিচের বাজার মূল্যও অনেক। মরিচ চাষের মাধ্যমে আমরা নারী/পুরুষ উভয়ে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যসস্থা নিজেরাই করে নিতে পারি। তার জন্য মরিচ চাষের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে আমাদের জানতে হবে।

মাটি ও জলবায়ু

মরিচ চাষের জন্য এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যে জমিতে বৃষ্টির পানি জমে থাকে না এবং বর্ষায় পানি উঠে না। জমিতে পানি নিষ্কাশনের  সু-ব্যবস্থা থাকতে হবে। যে স্থানে প্রচুর রোদ ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে মরিচ চাষের জন্য সেই স্থান নির্বাচন করতে হবে।

যে মাটিতে বেশি অম্ল আছে সে মাটি ছাড়া সব ধরনের মাটিতে মরিচ জন্মে। মরিচ চাষের জন্য দো-আশঁ মাটি সব থেকে উপযোগী এবং তাপমাত্রা হলো ৩৫ থেকে ৪৫ ডিঃসেঃ।

জাত পরিচিতি

সাধারণত মরিচকে দু ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- ঝাল মরিচ ও মিষ্টি মরিচ। বাংলাদেশে ঝাল মরিচের ব্যবহার বেশি। ঝাল মরিচের জনপ্রিয় জাতগুলোর মধ্যে নাগা মরিচ, বগুড়ার মরিচ, বিজলী মরিচ, চাঁদপুরী, ফরিদপুরীসহ ইত্যাদি জাত রয়েছে।

এছাড়াও আঞ্চলিক মৌসুমি জাতগুলো হলো- কামরাংগা, আকালী, কালো মরিচ, জিয়া মরিচ ইত্যাদি। আঞ্চলিকভাবে আরো কিছু  জাত রয়েছে, যেমন- মেজর, যমুনা, বালিঝুরা মরিচ, সাহেব মরিচ, বোম্বাই মরিচ, ধানী মরিচ, পাটনাই, গোল মরিচ, বারি মরিচের ৩ টি  জাত।

মরিচের বীজতলা তৈরি

মরিচের বীজ সরাসরি জমিতে বপণ করা যায়না, যার জন্য বীজতলা তৈরি করে নিতে হয়। বীজতলা তৈরির জন্য আদর্শ মাপ হলো ৩ মিটার লম্বা ও ১ মিটার চওড়া। তবে বীজতলায় চারার সংখ্যার উপর নির্ভর করে মাপ কম বেশি হতে পারে।

গ্রীস্মকালীন বীজতলার উচ্চতা ১৫ সেঃমি এর বেশি নয় এবং শীতকালীন বীজতলার জন্য ৭-৮ সেঃ মিঃ হতে হবে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থার জন্য গ্রীস্মকালীন বীজতলার উচ্চতা বেশি থাকে।

বীজ শোধন

জমিতে বা বীজতলায় বীজ বপণের আগে মরিচের বীজ শোধন করে নিতে হয়। বীজ শোধন করে নিলে চারা অবস্থায় রোগ বালাই কম হয়ে থাকে। প্রোভেক্স জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হয়।

নীরোগ চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপণের আগে  প্রতি কেজি বীজের সাথে ২ গ্রাম প্রোভেক্স-২০০ দ্বারা ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে তারপর ১০-১৫ মিনিট ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে শুকিয়ে নিতে হবে।

মরিচের বীজ বপণ পদ্ধতি

১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর বীজ থেকে পানি ঝরিয়ে হালকা ছায়াতে শুকিয়ে ঝরঝরা করে বীজতলায় ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজ বপণের উপযুক্ত সময়: বর্ষা মৌসুমের জন্য মার্চ – এপ্রিল মাস এবং রবি মৌসুমের জন্য অক্টোবর – নভেম্বর মাস।

মিষ্টি মরিচ রবি মৌসুমেই ভালে জন্মে আর ঝাল মরিচ বছরের সবসময়ই জন্মে থাকে। মরিচ বপণের সময় মনে রাখতে হবে- বীজ কোনোক্রমেই যেন ১-১.৫ সে.মি এর বেশি মাটির গভীরে না যায়। মরিচের বীজ সরাসরি বপণ করলে ১৫-২০ সে.মি. পরপর গাছ রেখে পাতলা করে দিতে হবে।

মরিচের চারা তৈরি ও রোপণ

বীজতলায় চারা যখন ১০ সে: মি: লম্বা হয় তখন চারা মুল জমিতে রোপণের উপযোগী হয়। মরিচ ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কারের পরে ৩-৪ টি চাষ এবং মই দিয়ে জমি প্রস্তুত করে চারা রোপণ করতে হয়।

মরিচের চারা লাগানোর সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০-৭০ সে.মি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০-৪০ সে.মি. রাখতে হবে। মরিচের চারা বিকালে লাগানো উচিৎ এবং ৩-৪ দিন সকাল-সন্ধ্যা পানি দিতে হবে।

মরিচ গাছে সার প্রয়োগ

মরিচ চাষে সার প্রয়োগের সময়কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটা চারা লাগানোর পূর্বের সময় এবং অন্যটা চারা লাগানোর পরে। এ দুটি সময়ের করণীয় পদ্ধতি নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে।

মরিচের চারা লাগানোর ২০-২৫ দিন পূর্বে গোরবসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে প্রতি হেক্টরে গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, টিএসপি ২০০ কেজি এবং এমওপি সার ১৫০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।

জমি তৈরির সময় টিএসপি, গোবর এবং এমওপি সার ৫০ কেজি প্রয়োগ করা হয়। মরিচের চারা রোপনের ২৫ দিন পর ৮৫ কেজি ইউরিয়া ৩৫ কেজি এমওপি সার প্রথম উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা  লাগানোর ৫০ দিন পর দ্বিতীয় ৭০ দিন পর তৃতীয় বার সার প্রয়োগ করতে হবে।

মরিচ গাছের পরিচর্যা সেচ

চারা লাগানোর পরে হালকা পানির সেচ দিলে চারা সহজেই সতেজ হয়। গ্রীষ্মকালে জমিতে ৪-৫ দিন পরপর এবং শীতকালে ১০-১২ দিন পরপর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষেতের মাটির রস কমে গেলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিবার সার প্রয়োগের পরে সেচ দেয়া প্রয়োজন। সেচের কয়েকদিন পর মাটিতে চটা ধরে। মাটি চটা ভেঙ্গে দিতে হয় যাতে করে শিকড় প্রয়োজনীয় বাতাস পায় এবং গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সময়মত নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার ও মাটি ঝুরঝুরা করাটায় হলো মরিচ গাছের পরিচর্যা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক।

মরিচ গাছের রোগ-বালাই ও প্রতিকার

সাধারণত, মাটি ও বীজের মধ্যে থাকা বিভিন্ন রকমের জীবাণু মরিচের রোগগুলোর জন্য দায়ী। রোগগুলোর মধ্যে ড্যাম্পিং অফ, গোড়া পচা, মূল পচা রোগ অন্যতম। এ রোগগুলো সচারাচর চারা অবস্থাতেই হয়ে থাকে।

উপরোক্ত রোগগুলো পিথিয়াম ও রাইজোকটোনিয়া নামক ছত্রাকের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। বীজতলায় বীজ বপণের পরপরই বীজ পচে যেতে পারে অথবা চারা গজানোর পর চারা গাছ ফ্যাকাশে, দুর্বল ও  লিকলিকে হয়ে যায়। ছোট অবস্থায় চারার গোড়ায় পানিভেজা দাগ পড়ে ও চারা ঢলে পড়ে এবং মারা যায়। এ রোগ থেকে রক্ষার উপায় হলো: মরিচের বীজ শোধন করে নেওয়া।

মরিচের ক্ষেতে মাইট ও থ্রিপসের আক্রমণ দেখা যায়। প্রতিকারের  জন্য ম্যালাথিয়ন/ মেটাসিসটক্স প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করলে এ সকল পোকা দমন করা যায়।

মরিচ গাছে এ্যানথ্যাকনোজ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে টিল্ট নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। সাদা মাছি ভাইরাস রোগ বিস্তারে সহায়তা করে থাকে, সাদা মাছি দমনের জন্য ডায়াজিনন প্রতি লিটার পানির সাথে ৩ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।

ফসল সংগ্রহ

মরিচ গাছে ফুল আসার পর ১৫-২০ দিরে মধ্যে কাঁচা মরিচ তোলা হয়। তবে মরিচের রং লাল হলে সেটিকে তুলে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। হেক্টর প্রতি কাঁচামরিচের ফলন ১০-১১ টন হতে পারে এবং শুকনো মরিচ ১.৫-২.০ টন হয়ে থাকে।

বীজ উৎপাদন

চাষীগণ খুব সহজেই মরিচ বীজ উৎপাদন করতে পারে। বীজ উৎপাদনের সময় খেয়াল রাখতে হবে- যে জাতের মরিচ চাষ করবেন তার চারপাশে অন্তত ১৩০০ ফুটের মধ্যে অন্য জাতের মরিচের গাছ যেন না থাকে।

মরিচ যখন পুষ্ট, পরিপক্ক, এবং উজ্জ্বল লাল রংয়ের হয় তখন বীজ সংগ্রহ  করতে হবে। একটি মরিচ থেকে ৭০ থেকে ৭৫ টি বীজ পাওয়া যায়। ১০০০টি বীজের ওজন হয় প্রায় ৫ গ্রাম, একর প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ কেজি বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।

বীজ সংরক্ষণ

ফসল তুলার পরে, মরিচ চিরে বীজ বের করতে হবে। বীজ শুকানোর পর ঠান্ডা করে বায়ু নিরদ পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। যেমন প্লাস্টিকের কৌটা অথবা কাচের পাত্র ইত্যাদি।

একজন চাষী যদি সঠিকভাবে আধুনিক উপায়ে কাঁচা মরিচ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে, তাহলে সহজেই লাভবান হতে পারবে।

13 Comments

  1. আকরাম March 6, 2021 Reply

    উপকারী সব তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ

    • Masud Bhuiyan May 11, 2021 Reply

      আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ

  2. মো:মোয়াজ্জেম হোসেন May 15, 2021 Reply

    বর্ষা মৌসুমে কোন জাতের মরিচ চাষ করলে কৃষক লাভোবান হতে পারবে, এবং বর্ষা মৌসুমে যদি সরাসরি বৃষ্টির পানি মরিচ গাছে পরে সেখেত্র ও কি মরিচ ধরবে??//

    • Masud Bhuiyan May 16, 2021 Reply

      সনিক অথবা বীজলি প্লাস মরিচ, বর্ষার পানি জমে না থাকলে কোন সমস্যা হবে না। গাছের গোড়াতে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। অবশ্যই ভালো কোন মাধ্যম থেকে বীজ নিবেন। আর যদি ভালো কোন মাধ্যম না পান তাহলে আপনি আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। 01832411422

  3. Samit Biswas May 29, 2021 Reply

    Khub khub bhalo lagcha.

    • Masud Bhuiyan May 30, 2021 Reply

      ধন্যবাদ

  4. ziaur rahman zihad August 31, 2021 Reply

    ভাই বম্বাই মরিচ চারার শিকড় বৃদ্ধি করার উপায় কি?

    • Success Farm August 31, 2021 Reply

      আশা করি এটা ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি খুব ভাল রেজাল্ট পাবেন https://successfarmbd.com/product/seed-germinator-roton-plus/
      এছাড়া আপনি নিম খৈল ব্যবহার করতে পারেন এটা অনেক কাজের। ধন্যবাদ, আমাদের সাথে থাকার জন্য

  5. Harun Or Rashid April 5, 2022 Reply

    Very helpful information.

  6. Bipul roy January 7, 2023 Reply

    ভাই মরিচ গাছের বেশি বেশি ডাল হবে এমন কোন কিটনাশক আছে নাকি,আরো দিলে আবার ক্ষতি হবে নাকি….? দয়া করে যানাবেন

  7. Anindita Datta May 21, 2023 Reply

    Thank you so much. 🥰

  8. Didarul Islam January 5, 2024 Reply

    ভাইয়া কৃষি কাজে আমি নতুন
    মরিচ রোপন করছি আট দিন হবে
    গাছ হলুদ হয়ে যাওয়ার কারণ কি

Leave a Comment

Your email address will not be published.

0

TOP

X