পেঁপে আমাদের দেশে একটি অন্যতম ফল। কাঁচা পেঁপে সবজি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, যশোর সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে পেঁপের চাষ করা হচ্ছে। ভরপুর পুষ্টিমানে সমৃদ্ধ ফলটি মানব দেহের রোগ প্রতিরোধে কাজ করে। পেঁপে একটি স্বপ্ল মেয়াদি ফল, অল্প জায়গাতেই পেঁপে চাষ করা যায়। বাড়ির আঙ্গিনায় অল্প কিছু গাছ লাগিয়ে সারা বছর সবজি ও ফল পাওয়া যায়। নিচে পেঁপে চাষের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
পেঁপের জাত নির্বাচন
আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতের পেঁপে চাষ করা হয়ে থাকে। পেঁপের সবথেকে প্রচলিত জাতগুলো হলো- রাচি, রেড লেডি, সুইট লেডি, শাহী পেঁপে, যশোরি, বলুস্টেম, ছোট পেঁপে, কাশিমপুরী, হাইব্রীড সহ প্রভৃতি জাত সমুহ। উল্লেখিত জাতগুলোর মধ্যে বর্তমানের সব থেকে ট্রেন্ডি জাত হলো সুইট লেডি। এই একটি হাইব্রীড বা উচ্চ ফলনশীল জাত। এছাড়া শাহী নামে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৯২ সালে একটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে। জাতটির বৈশিষ্ট্য হলো- এটি একলিঙ্গী জাত, গাছের উচ্চাতা ১.৬ থেকে ২.০ মিটার পর্যন্ত হয়। ছোট থেকেই কান্ডের খুব নিচু থেকে ফল ধরে। এ জাতটি দেশের সব অঞ্চলে চাষ উপযোগী।
পেঁপে চাষের জন্য উপযুক্ত মাটি ও জমি
পেঁপে চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি ভাল। পেঁপে গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। পেঁপের জন্য সেচ সুবিধাযুক্ত এবং জলাবদ্ধতা মুক্ত। পেঁপে চাষের জমি কয়েকবার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে মই দিয়ে তৈরি করতে হবে। জমিতে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য বেড পদ্ধতি অবলম্বন করা অতি উত্তম হয় । পানি নিষ্কাশনের জন্য বেড থেকে বেডের মাঝে ৩০সেমি চওড়া ও ২০সেমি গভীর নালা থাকবে। প্রতিটি বেড নালা সহ ২ মিটার চওড়া হবে এবং জমি অনুযায়ী লম্বা হবে।
পেঁপের চারা উৎপাদন পদ্ধতি
পেঁপের বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। পলিব্যাগে চারা তৈরি করা হলে রোপন করতে সুবিধা হয় এবং চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বীজতলায় চারা তৈরি করার জন্য ১০-১৫ সে.মি. সারি করে প্রতি সারিতে ৩-৪ সে.মি. গভিরে বীজ বপন করতে হবে।
পলিব্যাগে চারা তৈরি করতে হলে ১৫*১০ সে.মি. আকারে সমপরিমান বালি, মাটি, ও পচা গোবর মিশ্রণ দিয়ে সম্পুর্ণরূপে ভির্তি করেতে হবে। পলিব্যাগের নিচে ২-৪ টি ছোট ছিদ্র করতে হবে।
প্রটিতি পলিব্যাগে ২টি করে বীজ বপন করতে হবে। মাটিতে জো না থাকলে পানি দিতে হবে। বীজ বপনের ১৫- ২০ দিন পর চারা গজায় এবং ৪০-৫০ দিন পর জমিতে রোপণ উপযোগী হয়।
মাদা তৈরি
চারা থেকে চারার দুরত্ব হবে ২ মিটার। চারা রোপণের জন্য ৬০*৬০*৬০ সেমি গর্ত করতে হবে। গর্তের উপরের মাটি একপাশে ও নিচের মাটি অন্য পাশে রাখতে হবে। চারা রোপণের ১৫-২০ দিন আগে গথের উপরের মাটির সাথে ১৫ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ৫০০গ্রাম টিএসপি, ২০ গ্রাম জিংক সালফেট, ২০ গ্রাম বরিক এসিড মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে এবং বাগানে সেচ দিতে হবে।
পেঁপে গাছ রোপন পদ্ধতি
জমিতে দেড় থেকে দুই মাস বয়সের পেঁপে চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের আগে গর্তের মাটি ভালভাবে উলটপালট করে মিশিয়ে নিতে হবে। প্রতি গর্তে তিনটি করে চারা ৩০সেমি দুরত্বে ত্রিভুজ আকারে রোপণ করতে হবে।
বীজতলায় যে চরা উৎপাদন করা হয় সে চারার উন্মুক্ত পাতা ফেলে দিতে হবে রোপণের আগে। এতে করে চারার মৃত্যুর হার কম হয় এবং চারা তারাতারি বৃদ্ধি পায়। পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই সারির মাঝখানে নালা রাখতে হবে। বানিজ্যিক আকারে পেঁপে চাষের জন্য বর্গাকার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
পেঁপে চাষে সার ব্যবস্থাপনা
পেঁপে গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি: ভাল ফলন আশা করলে সময় মতো সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি গাছে ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া এবং এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের পর গাছে নতুন পাতা আসলে ইউরিয়া ও এমওপি সার ৫০ গ্রাম করে প্রতি মাসে দিতে হবে।গাছে ফুল আসলে সার প্রয়েগের মাত্রা দ্বিগুন করতে হবে। মাটিতে জো না থাকলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। পেঁপে গাছে সার প্রয়োগের নিয়মগুলো মেনে সঠিক সময়ে দিতে হবে, তবেই ভালো ফলন আশা করা যাবে।
পেঁপে গাছের পরিচর্যা
- পেঁপের জমি সবসময় আগাছা মুক্ত রাখতে হয়।
- বর্ষা মৌসুমে আগাছা দমন করার সময় মাটি যাতে বেশি আলগা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- গাছ ঝড়ের সময় ভেঙ্গেনা যায় তার জন্য বাঁশের খুটি দিয়ে গাছ বেধে দিতে হয়।
পানি সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা:
- চারা রোপণের পর এবং সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হয় তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি সেচ দিতে হয়।
অতিরিক্ত গাছ অপসারণ:
- ফুল আসলে প্রতি গর্তে একটি সুস্থ সবল স্ত্রি গাছ রেখে বাকি গাছ কেটে ফেলতে হয়।
- বাগানে সঠিকভাবে পরাগায়ণের জন্য বাগানে ১০% পুরুষ গাছ রাখা দরকার।
ফল পাতলা করণ:
- অধিকাংশ পেঁপের জাতের ক্ষেত্রে একটি পত্রক থেকে একাধিক ফুল আসে ও ফল ধরে।
- ফুল হতে ফল নিশ্চিত মনে হলে প্রতি বোটায় সবথেকে ভাল একটি ফল রেখে বাকিগুলো ছিড়ে ফেলতে হবে।
- পরবর্তী বছর থেকে যে পেঁপে হয় ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে, সেগুলো ফলে ঠিকমতো বড় হতে পারে না এবং এদের সাইজ নষ্ট হয়।
- সেক্ষেত্রে ছোট ছোট ফল গুলো চাঁটাই করতে হয়।
পেঁপের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
পেঁপের সাধারণত যে রোগ গুলো দেখা যায় সে গুলো হলো-
- ঢলেপড়া ও কাণ্ড পঁচা রোগ
- পাতা কোঁকড়ানো
- এ্যানথ্রাকনোজ
- মোজাইক রোগ
- এবং পোকার মধ্যে মিলিবাগ।
ঢলেপড়া ও কাণ্ড পঁচা রোগ
বাগানের মাটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকলে চারা ঢলেপড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এবং বর্ষাকালে কাণ্ডপচা রোগ হতে পারে। কাণ্ড পচা রোগ হলে গাছের গোড়ার দিকে বাদামি বর্ণের পানি ও ভেজা দাগ দেখা যায়। এ রোগ হলে আক্রান্ত চারা ও গাছ মারা যায় ও ঢলেপড়ে।
প্রতিকার
বীজতলার মাটি শুকনা রাখতে হয় এবং ছত্রাক নাশক ২-৩ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে শোধন করতে হবে। আক্রান্ত চারা উঠিয়ে ফেলতে মাটিতে পুতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ২ গ্রাম রিডোমির এম জেড-৭২ ছত্রাক নাশক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে কাণ্ডে স্প্রে করতে হবে।
পেঁপের মোজাইক রোগ
এটি ভাইরাস জনিতএকটি রোগ। এ রোগের কারণে পেঁপে গাছের পাতায় হলুদ রং এর ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। পাতার বেঁটা বেঁকে থাকে এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। যাব পোকার আক্রমণে এরোগ বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার
আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগ বিস্তার করা পোকা দমন করে এ রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। এজন্য নোভাস্টার ৫৬ইসি ০২ মিলি বা হেমিডর বা পিমিডর বা এডমায়ার ২০০ এসএল ০১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন স্প্রে করতে হবে।
মিলিবাগ পোকা
বর্তমান সময়ে মিলিবাগ পেঁপের একটি ক্ষতিকর পোকা হিসাবে আর্বিরভাবহয়েছে। এ পোকার আক্রমণে গাছের পাতা ও ফর শুটি মোল্ড রোগের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত পাতা ও ফলে সাদা পাউডারের মতো আবরণ পড়ে। আক্রমণের মাত্র বেশি মাত্রায় হলে গাছ মারা যেতে পারে।
প্রতিকার
আক্রমণের প্রথম দিকে আক্রান্ত পাতা ও ফল বা কাণ্ড সংগ্রহ করে মাটিতে পুতে বা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে এডমায়ার ২০০এসএল ০.২৫ মি.লি. হারে বা সাবানের পানি ৫ গ্রাম মিশিয়ে ৫-৭ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
ফল সংগ্রহ
পেঁপে সবজি হিসাবে ব্যবহার করলে ফলের কষ যখন হালকা হয়ে আসে এবং জলীয় ভাব ধারণ করবে তখন সংগ্রহ করতে হবে। ফলের গায়ে যখন হালকা হলুদ ভাব দেখা যাবে তখন ফল হিসাবে সংগ্রহ করতে হবে।
পেঁপের ফলন
উপযুক্ত নিয়মে ও পেঁপে চাষ করার নিয়মগুলো অনুশরণ করলে হেক্টর প্রতি ৪০ থেকে ৬০ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়।
সুইট লেডি হাইব্রিড পেঁপে-Sweet Lady Papaya বীজের জন্য লিংকে ক্লিক করুণ