0
ডালিমের রোগ

বেদানাআনার বা ডালিম এর বৈজ্ঞানিক নাম: Punica granatum, ইংরেজি নাম: pomegranate । ক্ষতিকারক পোকা-মাকড়ের আক্রমণের ফলে ডালিমে বিভিন্ন ধরণের রোগ-বালাই হয়ে থাকে। এসব রোগ-বালাইয়ের কারণে গাছের ৫০% ফল নষ্ট হয়ে যায়। গাছের ফল যেন নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্য ডালিমের রোগ-বালাই ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে হবে।

সুস্থ্য সুন্দর ডালিম উৎপাদনের জন্য এ সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার সঠিক নির্দেশনা নিচে আলোচনা করা হলো-

রোগ ও পোকা-মাকড়

  • ডালিমের এনথ্রাকনোজ রোগ
  • ডালিমের বোটা/ মাথা/ ফল পঁচা রোগ
  • ফলের দাগ রোগ
  • ডালিমের গ্রে মোল্ড রোগ
  • ডালিমের প্রজাপ্রতি বা ফল ছিদ্রকারী পোকা
  • ডালিমের কান্ড ছিদ্রকারী পোকা
  • ডালিমের রস শোষণকারী পোকা
  • ডালিম গাছে মাকড়।

ডালিম গাছের মাটিতে যখন পুষ্টির অভাব দেখা যায় তখন গাছে রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। গাছে পুষ্টির অভাবের সাথে সাথে রোদের অভাব হলে, অতি বৃষ্টিপাত হলে এবং সর্বোপরি জমিতে সেঁচের তারতম্য হলে নানা ধরণের রোগ-বালাই  আক্রমণ করে থাকে।

এনথ্রাকনোজ রোগ

এনথ্রাকনোজ রোগের লক্ষণ:

ডালিমের এনথ্রাকনোজ রোগ

ডালিমের রোগ-বালায়ের মধ্যে এনথ্রাকনোজ রোগ অন্যতম ডালিম গাছে এনথ্রাকনোজ রোগ হলে গাছের কচি পাতায় অনিয়মিত দাগ দেখা যায়। গাছের কচি ফল গুলো কালো হয়ে শুকিয়ে যায় ও ফল এক সময় ফেটে যায়, ফল মাঝে মাঝে ঝরে পড়ে।

এনথ্রাকনোজ রোগের প্রতিকার:

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোদ করাটাই বেশি জরুরি। প্রতিনিয়ত বাগান পরিস্কার করতে হবে। বাগানে আগাছা জন্মাতে দেওয়া যাবে না। গাছের নিচের ঝরে পড়া পাতা ও ফল পরিস্কার করতে হবে। গাছে ফল মটর দানার আকার ধারণ করলে ম্যানকোজেব বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। ফল ছোট অবস্থায় থাকতেই ফ্রুট ব্যাগিং করে দিলে পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ফল সংগ্রহের পর করনীয়:

ডালিম গাছের ফল সংগ্রহ করার পর গাছের সমস্ত মরা ডাল-পালা, ফলের বোটা, রোগ বা পোকা-মাকড়ে আক্রান্ত ডাল পালা ও অপ্রয়োজনীয় ডাল ছাঁটাই করে দিতে হবে। গাছ পরিস্কার করার পর ছত্রাক নাশক ও কীটনাশক দিয়ে পুরো গাছ ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।

ফল পঁচা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার: 

ডালিমের ফল পঁচা রোগ

ছত্রাকের আক্রমণের কারনে এ রোগটি সাধারণত বর্ষাকালে দেখা যায়। ফুলে যদি এ রোগ আক্রমণ করে তা হলে ফল ধারণে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং কচি ফল গুলো ঝরে পড়ে। 

রোগের লক্ষণ

বোঁটায় কালো বা হলুদ দাগ দেখা যায়। এ রোগ প্রথমে বোটা থেকে পচন শুরু করে এবং পরে  ফল পচেঁ যায়। আক্রান্ত ফলের খোসা কুঁচকে যায় ও ফলের ওজন কমেযায়। প্রথমে ছত্রাক ও পরে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে ফল খুব তারাতারি পচেঁ যায়। আক্রান্ত ফল  আকারে ছোট হয় ও কাচা থাকে এবং ফলের  উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়।

প্রতিকার: 

এ রোগে আক্রান্ত ডাল-পালা ও ফল মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কার্বান্ডিজম ৫০ ডব্লিউপি ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

দাগ রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার:

ডালিম ফলের দাগ রোগ

এটি ছত্রাক জনিত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হলে ফলের উপর ছোট ছোট ও অনিয়মিত দাগ দেখা যায়। দাগগুলোর চারপাশে হলদে সবুজ দাগ থাকে। একসময়ে এই দাগগুলো লম্বা হয়ে যায় এবং ফলের খোসার নিচের বীজগুলো বাদামি বর্ণ ধারণ করে। এ রোগের আক্রমণের কারণে ফলের গুণাবলী নষ্ট হয়ে যায়।

প্রতিকার:

এ রোগের প্রতিকার ফল পচাঁ রোগের অনুরূপ।

ডালিমের গ্রে মোল্ড রোগ

ডালিম ফলের গ্রে মোল্ড রোগ দেখা দিলে গাছের পাতায় পানি ভেজা দাগ পড়ে এবং ফলের উপর ছত্রাকের আস্তরণ পড়ে। আস্তরণের কারণে ফল এক সময় পচেঁ যায়।

প্রতিকার:

কপার অক্সিক্লোরাইট বা বোর্দে মিশ্রণ জাতীয় ছত্রাক নাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ৭ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

প্রজাপ্রতি বা ফল ছিদ্রকারী পোকা:

ডালিমের প্রজাপ্রতি বা ফল-ছিদ্রকারী-পোকা

ডালিম ফলের মারাত্মক শত্রু হচ্ছে প্রজাপতি পোকা বা ফল ছিদ্রকারী পোকা। প্রজাপতি পোকার শূঁককীট ফলের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। ডালিমের ফুল ও ছোট ছোট ফলের উপর স্ত্রী প্রজাপ্রতি ডিম পাড়ে। ডিম থেকে শূঁককীট বের হয়ে ফল ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে পড়ে।

ফলের ভিতরে বীজ ও অন্যান্য অংশ খেয়ে থাকে। পরর্বতীতে মুককীটে পরিণত হওয়ার আগে ফলের ত্বকে গোলাকার ছিদ্র করে  ফল থেকে বাহিরে বের হয়ে আসে। প্রজাপ্রতি পোকা আক্রান্ত ফলে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হতে পারে।

প্রতিকার:

যে ফল প্রজাপ্রতি পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয় সে ফলগুলো গাছ থেকে পেড়ে ও মাটিতে পড়ে থাকা ফল কুড়িয়ে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে অথবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছে ফলবৃদ্ধির সময় ব্যাগিং করে দিতে হবে। কার্বরিল, ম্যালাথিয়ন বা ফসফামিডন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর গাছে ও ফলে স্প্রে করলে এ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

কান্ড ছিদ্রকারী পোকা

ডালিমের কান্ড ছিদ্রকারী পোকা

সাধারণত পরিচর্যা বিহীন বাগানে বা গাছে কান্ড ছিদ্রকারী পোকা আক্রমন করে থাকে। এই পোকার শূঁককীটগুলো রাতের বেলাতে গাছের কান্ড ও শাখার ছাল ছিদ্র করে ভিতরে যায় এবং ভেতরের অংশ খেয়ে ফেলে। দিনের বেলাতে এরা গাছের গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং বর্জ্য ত্যাগ করে।

প্রতিকার:

গাছের কান্ডের গর্তের মধ্যে সরু তার ঢুকিয়ে পোকার কীড়াগুলোকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে হবে। গর্ত থেকে বর্জ্য পরিস্কার করে গর্তে ইনজেকশনের মাধ্যমে কেরোসিন বা পেট্রোল ঢুকিয়ে, কাদা দিয়ে গর্ত বন্ধ করলে পোকা মারা যায়।

রস শোষণকারী পোকা

সাদা মাছি, ছাতরা পোকা, থ্রিপস, জাব পোকা, মাকড়, শুল্ক বা আঁশ পোকা ডালিমের রস শোষণকারী পোকা হিসাবে পরিচিত। এসকল পোকার আক্রমণে ডালিম গাছের পাতা, মুকুল, ফুল, ও ছোট ফল ঝরে পড়ে। জাব পোকা ও সাদা মাছি গাছের কচি পাতা ও কচি ডগার রস চুষে খায় এবং আক্রান্ত অংশে বিকৃত ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে।

এসকল পোকার দেহ থেকে এক ধরণের মধু নিঃসৃত হয়ে থাকে যা পাতায় লেগে যায়। এই নিঃসৃত মধুর উপর এক ধরণের ছত্রাক জন্মায়। যার কারণে গাছের খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। মাকড় ও থ্রিপস পোকা পাতা, ফুলের বোঁটা, বৃত্তি ও দলমগুলোর অংশ ক্ষত করে এবং ক্ষত থেকে বের হওয়া রস খেয়ে থাকে। পাতার রস চুষে খাওয়ার কারণে আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে ও শুকিয়ে যায় এবং ফুল ঝরে পড়ে।

প্রতিকার:

 ছাতরা পোকা ও শুল্ক পোকার কীট দমনের জন্য এসকল পোকার আক্রমণের প্রথম দিকেই ডালিম গাছের আক্রান্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ডায়াজিনন জাতীয় কীটনাশক ১ মিলি প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।

সাদা মাছি ও জাব পোকা দমণের জন্য প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলি হারে ডাইমেথয়েট অথবা ০.৫ মিলি হারে ইমিডাক্লোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক মিশিয়ে ১০-১২ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।

মাকড় দমণের জন্য প্রতি লিটার পানির সাথে ১.২৫ মিলি হারে ভার্টিমেক অথবা সানমেক্টিন  মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

পাতা মোড়ানো পোকা

ডালিমের পাতা মোড়ানো পোকা

এ পোকা পাতামুড়িয়ে পাতার নিচে বসে পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। বড় গাছের জন্য বেশি ক্ষতিকর না হলেও ছোট গাছকে অনেক সময় পত্রশূণ্য করে ফেলে।

প্রতিকার:

আক্রান্ত গাছের পাতা ও ডগা ছাটাই করে এবং মাটিতে পড়ে থাকা পাতা সংগ্রহ করে মাটিতে পুতে অথবা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংশ করতে হবে। এ রোগের জন্য কীটনাশক সুপারিশকৃত নয়, কিন্তু আক্রমণ বেশি হলে প্রতিলিটার পানিতে সুমিথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক ২ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published.

0

TOP

X